হামলার কারণ হাট-ঘাট নাকি স্বর্ণ চোরাচালান ?

হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে জোর অভিযান চলছে: এএসপি জাকিয়া সুলতানা

জীবননগরে একমাসের ব্যবধানে দুজন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যানকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় আজও অপরাধীরা আড়ালেই

এক মাসের ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় এখনো কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। একমাসের ব্যবধানে দুটি ঘটনায় এখনো জেলা জুড়ে ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মধ্যে এই হামলার আতঙ্ক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

যা সরেজমিনে উঠে এসেছে। হাট-ঘাট, স্বর্ণ চোরাচালান নাকি রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে একেরপর এক হামলার ঘটনা তা পরিস্কার হওয়া যায়নি। যদিও হামলার শিকার দুজন চেয়ারম্যানই জীবননগর থানায় আলাদা আলাদা দুটি অভিযোগ দিয়েছেন তারপর পুলিশ আজও পর্যন্ত এর কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। তবে পুলিশ বলছে, দ্রুতই তারা অপরাধী আটকসহ প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করবে। এখন প্রশ্ন সেটা কবে?

জেলার বেশ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে কথা হলে আজকের খাসখবরকে তারা জানান, একজন ইউপি চেয়ারম্যান যদি ইচ্ছামতো ঘুরতে ভয় পায় তাহলে জনগণের সেবা কিভাবে দেবে? দুজন চেয়ারম্যানের ওপর হামলাকারী এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় ভয়-আতঙ্ক আমাদের পেয়ে বসছে। আমরা পুলিশের মুখের দিকে চেয়ে আছি। তারা দ্রুত এসমস্ত ঘটনার রহস্য উদঘাটন করুক।

জীবননগর অঞ্চলের একজন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তির সাথে কথা হলে, তিনিও নাম না প্রকাশ করে বলেন, গত ২৮ মে জীবননগর উপজেলার উথলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নানকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে হামলা এবং গত ২৮ জুন একই স্টাইলে মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খান সুরুদ্দিনের ওপর হামলার ঘটনা আমাদের চিন্তিত করেছে।

আরও আশ্চর্যের বিষয় এই দুটি ঘটনায় এখনো পর্যন্ত পুলিশ কোনো কূল-কিনারা পায়নি। প্রথম ঘটনা দেড় মাস হতে চললো আর দ্বিতীয় ঘটনা ১০দিনের বেশি হয়ে গেলো, পুলিশ কিছুই পেলো না। পুলিশের চেয়ে কি দুর্বত্তরা বেশি চালাক হয়ে গেলো। এতে আমরা হতবাক হয়েছি। এভাবে যদি একের পর এক হামলার ঘটনা চলে, তাহলে তো সেটা ভয় ও আতঙ্কের।

এবিষয়ে হামলার শিকার উথলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার একমাত্র ছেলে রাব্বী নেওয়াজের সাথে আজকের খাসখবরের কথা হয়। রাব্বী নেওয়াজ বলেন, আব্বার ওপর হামলার ঘটনায় থানায় আমি বাদী হয়ে একটি অভিযোগ দিয়েছিলাম।

তবে আশ্চর্যের বিষয়, আজও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি। আমি মাঝেমধ্যে পুলিশের কাছে খোঁজখবর নিলে তারা বলে খুব দ্রুতই অপরাধীরা গ্রেপ্তার হবে।

রাব্বী নেওয়াজ আরও বলেন, মাঝেমধ্যে ডিবি পুলিশ আসে আর বলে, তারা নাকি খুব দ্রুতই সব রহস্য উদঘাটন করবে। দেড়মাস হয়ে গেলো, এখনো তো কিছুই হলো না।

আপনার পিতার কোনো শত্রু ছিলো কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- আমাদের জানামতে আব্বার কোনো শত্রু ছিলো না।

এই হামলা ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্ব আছে কী? এমন প্রশ্নের জবাবে রাব্বী নেওয়াজ বলেন- আমার আব্বা খুব ফ্রেস মানুষ, এমন কোনো দ্বন্দ্বের কথা আমার জানা নেই।

এদিকে, এবিষয়ে মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খান সুরুদ্দিনের সাথে কথা হলে, তিনি বলেন- আমার ওপর হামলার ঘটনায় আমার বড় ভাই বাদী হয়ে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে এখনো পর্যন্ত পুলিশ কাউকে আটক বা হামলার ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন- আমরা জনপ্রতিনিধি। আমাদের কাছে মানুষ আসে সেবা নিতে। তাই আমাদের কোনো টাইম ফ্রেম নেই। ভোর, রাত সকাল-বিকেল সবসময় মানুষ আসবে। কিন্তু আমার ওপর হামলার ঘটনায় সব চেয়ারম্যানরাই ভয়ে আছে। তবে পুলিশের ওপর আমার বিশ্বাস আছে, তারা দ্রুত এঘটনার রহস্য উদঘাটন করবে।

সুরুদ্দিন চেয়ারম্যান আরও বলেন- আমার তো কোন শত্রু নেই। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না কেউ আমার ওপর হামলা করবে। পুলিশের উচিৎ দ্রুত এর সমাধান করা। নাহলে সব চেয়ারম্যানই আতঙ্কে থাকবে।

এবিষয়ে এর আগে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আলী আজগর টগরের সাথে কথা হয়েছিলো আজকের খাসখবরের। সেসময় তিনি বলেছিলেন- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, তারা কাজ করছে। আমিও তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছি।

এদিকে, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের অন্তর্গত জীবননগর ও দামুড়হুদা উপজেলার অধিনস্থ ইউনিয়নগুলোর চেয়ারম্যানদের মধ্যে একটু বেশিই আতঙ্ক কাজ করছে। সরেজমিনে যা উঠে এসেছে। যদি কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাই একটু সতর্কভাবে চলাচল করছেন।

আরও আশ্চর্যের বিষয় এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সময় কয়েকজন চেয়ারম্যানের সাথে কথা হলে তারা কোনো মন্তব্যই করতে চাননি। আবার অনেকে ফোনও রিসিভ করেননি। এছাড়া যারা কথা বলেছেন তারাও নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজী নন।

হামলার ঘটনার পর সরেজমিনে গেলে আরও জানা যায়- জীবননগরের একজন সাংবাদিকও তার চলা ফেরায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন। অসমর্থিত সূত্র জানায়- পুলিশ ও সাংবাদিককে সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছেন।

এছাড়া জীবননগর এলাকার বেশ কিছু মানুষের সাথে আজকের খাসখবরের কথা হলে, তারা নাম প্রকাশ তো দুরের কথা, বক্তব্যই দিতে রাজী হননি। তবে এমন কয়েকজন ব্যক্তির সাথে আলাপকালে উঠে এসেছে- হাট-ঘাট ও স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের নানা কথা।

অনেকেই ধারণা করছেন- এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পর এ অঞ্চলের অপরাধী সিন্ডিকেট সতর্কতা অবলম্বন করছে। এছাড়া বিভিন্ন ঘটনা ভিন্নখাতে নিতেও দুজন চেয়ারম্যানের ওপর হামলা হতে পারে। আবার বেশ কয়েকজন এটাকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলেও মতামত দিয়েছেন।

তবে সম্প্রতি জীবননগর থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সচেতনমহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সচেতন মহলের কয়েকজন বলেন- জীবননগর উপজেলায় এদানিং মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম বেড়েছে। দুজন চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলো। থানা পুলিশও কিছুই করতে পারছে না। সবমিলিয়েই চিন্তার বিষয় বৈকি।

এবিষয়ে জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস.এম জাবীদ হাসানের সাথে কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার তার সরকারি মোবাইল ফোন নাম্বারে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তাছাড়া পরবর্তীতে ফোন কলও করেননি। সরকারি নাম্বার রিসিভ না করা ও পরবর্তীতে কল না করা একজন ওসির দায়িত্ব অবহেলার মধ্যেও পড়ে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।

এবিষয়ে দামুড়হুদা ও জীবননগর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জাকিয়া সুলতানার সাথে কথা হলে, তিনি বলেন- দুজন ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তারে আমরা জোর অভিযান চালাচ্ছি। প্রকৃত রহস্য দ্রুত উদঘাটনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, দুজন চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনার পর আমরা দুটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। দুজন চেয়ারম্যানের স্বজন বাদী হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।

উল্লেখ্য, গত ২৮ মে জীবননগর উপজেলার উথলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নানকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায় দুর্বত্তরা। এখনো তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন। এর ঠিক এক মাসের মাথায় গত শুক্রবার (২৮ জুন) এই জীবননগর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খান সুরুদ্দিনকে হত্যাচেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে তিনিও মারাত্মক জখম হয়ে প্রথমে যশোর পরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে তিনি রেফার্ড হয়ে এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন।