‘মৃত্যু পরোয়ানা’ নিয়ে গুনছে প্রহর

মেহেরপুর-মুজিবনগর এবং মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা প্রধান সড়কের উন্নয়নকাজের নামে কাটা হবে প্রায় দেড় সহস্রাধিক গাছ

প্রয়োজন নেই, তবুও কাটা হবে প্রায় দেড় সহস্রাধিক গাছ। লাল রঙের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু পরোয়ানার চিহ্ন শরীরে ধারণ করে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। গুনছে মৃত্যুর প্রহর। এই দৃশ্য মেহেরপুর-মুজিবনগর এবং মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা প্রধান সড়কের। মেহেরপুরের বন বিভাগ, সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং জেলা পরিষদ এই গাছগুলো কাটার দায় একে অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছে।

জেলা পরিষদ, বন বিভাগ এবং সড়ক ও জনপদের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাছগুলোর প্রকৃত মালিক মেহেরপুর জেলা পরিষদ। বন বিভাগের সহায়তায় সড়ক দুটির পাশে গাছগুলো লাগিয়েছিল জেলা পরিষদ। সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য গাছ কাটতে ইতোপূর্বে জেলা পরিষদকে চিঠি দিয়েছিল সড়ক ও জনপদ বিভাগ। গাছ কাটার অনুমতির জন্য জেলা প্রশাসক ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে প্রাথমিক একটি সমীক্ষা তৈরি করে জমা দিয়েছে জেলা পরিষদ। অনুমোদন পেলে গাছ কাটার দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তবে সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে, মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কে গাছ কাটার জন্য দেড় বছর আগে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সড়কের উন্নয়নকাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন নতুন করে গাছ কাটলে সড়কে আবার খানাখন্দের সৃষ্টিসহ নানা জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের শুধু মেহেরপুর থেকে আমঝুপি পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার রাস্তা চার লেনে উন্নীত করা হবে। কিন্তু গাছ কাটার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে মেহেরপুর থেকে দরবেশপুর পর্যন্ত সীমান্তজুড়ে, যেটা সম্পূর্ণভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত।

আরো পড়ুন=>> যশোরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন নিহত

আর বন বিভাগ বলছে, তাদের দায়িত্ব শুধু গাছ গণনা ও মূল্য নির্ধারণ। রাস্তা সড়ক বিভাগের আর গাছের মালিকানা জেলা পরিষদের। উল্লিখিত সড়ক দুটিতে দেখা গেছে, বট, পাকুড়, কড়ই, রেইনট্রি, মেহগনি, শিশু,কাঁঠাল, আম, জামসহ নানা প্রজাতির গাছ। সব গাছেই লাল রং ব্যবহার করে করা হয়েছে নম্বরিং। গাছে লাল রং অর্থই হচ্ছে গাছের মৃত্যু পরোয়ানা। দেখা যায় কিছু গাছ সড়কের একটু উপরে, আবার বেশিরভাগ গাছই রয়েছে সড়কের বাইরে। অদ্ভুতভাবে প্রায় সবগুলো গাছেই নম্বরিং করা হয়েছে। এসব গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নেওয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন মেহেরপুরের সাধারণ মানুষ।

তাদের মতে যদি ফের দেড় হাজার শতবর্ষী পুরোনো গাছ কেটে ফেলা হয় তাহলে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে পরিবেশের ওপর।

মেহেরপুর পৌর এলাকায় বসবাসকারী হুজাইফা ডিক্লেয়ার বলেন, গত বছর মেহেরপুর কুষ্টিয়া সড়কের তিন সহস্রাধিক শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সড়ক দুই লেন থেকে চার লেনে প্রশস্তকরণের জন্য। দেখা গেছে গত বছর যে সকল গাছ কাটা হয়েছে ওইসব এলাকা এখন মরুভূমিতের পরিণত হয়েছে। তার ওপরে এ বছর তীব্র দাবদাহে মানুষ ও প্রাণিকুলের জীবন ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হয়েছে। বড় বড় গাছ কেটে উজাড় করার কারণে চলতি বছরে দাবদাহ বেশি অনুভূত হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ বলেন, গাছ, পাহাড় ও নদী হলো জীববৈচিত্র এবং পরিবেশের প্রাণ। সেই গাছ নিধন করলে বিপাকে পড়ে পরিবেশ। যার প্রভাব পড়ে প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণিকুলের উপরেও। গাছ হচ্ছে পাখিদের আবাসস্থল, এর নিচে পথচারী ও পশু পাখি বিশ্রাম নেয়। নিচে পথচারী ও শ্রমিকরা কাজের মাঝে বিশ্রাম নেয়। বিভিন্ন পশু পাখির খাদ্যের উৎসও হচ্ছে গাছ। এছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে অক্সিজেন উৎপাদনের বিষয়টিও চিন্তা করতে হবে। জীব ও পরিবেশ বৈচিত্র রক্ষার্থে অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃক্ষ নিধনের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরি।

মেহেরপুর জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস টি হামিম হায়দার বলেন, বন বিভাগ শুধু গাছ গণনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। গাছগুলো জেলা পরিষদের। সড়ক সওজের। তারা গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিলে শুধু গাছের মূল্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পড়ে বন বিভাগের ওপর।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, ‘আমি একজন পরিবেশবাদী ও বৃক্ষপ্রেমী ব্যক্তি। গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জন্য কষ্টকর। সওজ সড়ক সম্প্রসারণের প্রকল্প নেওয়াতে গাছ কেটে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তবে গাছে নম্বরিং করা হলেও মোট কতগুলো গাছ কাটা হবে সেটা এখনই চূড়ান্ত নয়।’

সওজ মেহেরপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা সড়ক প্রশস্ত ও চার লেন করার প্রক্রিয়া চলছে। এতে জেলা পরিষদের লাগানো কিছু গাছ কাটা পড়বে। তবে মেহেরপুর মুজিবনগর সড়কে গাছ রেখেই সড়কের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমাপ্ত করা হয়েছে। সেখানে নতুন করে আর কোন গাছ কাটার প্রয়োজন নেই। এতে বরং সড়কের ক্ষতি হবে। এই সড়কের গাছ না কাটার জন্য শিগগিরই সওজের পক্ষ থেকে আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দেব।’

মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. শামীম হাসান বলেন, ’পরিবেশ সুরক্ষায় গাছ যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তেমনভাবেই রাষ্ট্র ও এলাকার উন্নয়নে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব জরুরি। সড়ক নির্মাণ করার পরেও সড়ক ও জনপথের আরও জায়গা থাকবে। সেখানে পুনরায় নতুন করে কীভাবে গাছ রোপণ করা যায় সে বিষয়ে বন বিভাগকে উদ্যোগী হতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।’