রাসেল ভাইপার আতংকিত নয় সচেতন হন

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রধানত ৫ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ পাওয়া যায়- কোবরা (গোখরা), ক্রেইট (কালকেউটে), রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া), গ্রীন পিট ভাইপার এবং সামুদ্রিক সাপ। কোবরা ও কালকেউটে বেশি দেখা গেলেও, গ্রীন পিট ভাইপার এর দেখা মেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের, আর সমুদ্রে সামুদ্রিক সাপ।


কয়েক বছর পূবেও রাসেল ভাইপারের নাম শোনা না গেলেও বেশ কয়েক বছর ধরে সীমান্তবর্তী জেলা গুলো রাসেল ভাইপার পাওয়া খবর পাওয় যাচ্ছে। আর এর পর থেকে এই রাসেল ভাইপার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।এই ভুল তথ্যগুলোর জন্য মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। সামজিক মাধ্যমে থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে ও সেই আতংকে খরব। আর এ সেজন্যই আজকের লেখা।

কয়েকটা মিথ এখন আমাদের সামনে, সেটা হলো রাসেল ভাইপার মানুষকে তাড়া করে, রাসেল ভাইপার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত সাপ, রাসেল ভাইপার দংশনে মৃত্যু অনিবার্য। যার কোনটাই সঠিক না। রাসেল ভাইপার কেন কোন সাপই মানুষকে তাড়া করে না। সাপ নিজে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা দেখলে নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে মাত্র।

দুই রাসেলভাইপার এর চেয়েও অনেক বেশি বিষাক্ত সাপ আছে (যেমন, ইনল্যান্ড তাইপান, ব্লাক মাম্বা ইত্যাদি)। তিন আমাদের দেশের প্রচলিত যেসব বিষাক্ত সাপ রয়েছে (কোবরা, ক্রেইট) তাদের বিষের ধরন এবং রাসেল ভাইপারের বিষের ধরন একই রকম।

তবে রাসেল ভাইপারের বিষের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে যা হলো রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। সেজন্য শরীরে যে কোনো জায়গায় রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত জমাট বাঁধবে না, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হবার সম্ভাবনা থাকে।


আশার কথা হলো রাসেল ভাইপারসহ আমাদের দেশের অন্যান্য বিষাক্ত সাপের বিষের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। দেশের হাসপাতাল গুলোতে এখন পর্যন্ত যে সকল রাসেল ভাইপার দংশনের রোগীর চিকিৎসা হয়েছে এবং অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।


সাপ দংশনের মৃত্যুর প্রধান কারন অসচেতনতা। এবং বিষক্রিয়ার লক্ষ্মণ বুঝতে না পারা। সর্প দংশনের কতক্ষণ পর বিষক্রিয়া দেখা যাবে নির্ভর করে সাপ কতটুকু বিষ শরীরে প্রয়োগ করেছে, সাপটি দংশনের কতক্ষণ পূর্বে খাবার খেয়েছে, দংশিত স্থানটি (হাত বা পা) কেমন নড়াচড়া করা হচ্ছে ইত্যাদির উপর। তবে বিষাক্ত সাপ কামড়ানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে শরীরে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই সময়ের মধ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা না দিলে ধরেই নেয়া হয় যে রোগীর আর বিষক্রিয়া হবার আশঙ্কা নেই।


আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাপ হলো অবিষাক্ত। তাই যেসব মানুষকে অবিষাক্ত সাপ কামড় দেয় অথবা বিষাক্ত সাপ কামড় দিয়েছে কিন্ত শরীরে সাপের বিষক্রিয়া হয় নাই, তাদের কোনো চিকিৎসা দরকার হয় না। অর্থ্যাৎ তারা এমনি ভালো হয়ে যান।


সাপের কামড়ে যারা মারা যান তারা সাধারণত কর্মক্ষম এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন। একটু সচেতন হলে এসব মৃত্যু আমরা ঠেকাতে পারি।


সাপ কামড়ালে করণীয়


প্রথমত আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। কারণ আমাদের দেশে বিষাক্ত সাপের সংখ্যা কম। আর বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও শরীরে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ ভাগ।


দ্বিতীয়ত যে জায়গায় সাপ কামড় দিয়েছে সে জায়গাটা নাড়ানো যাবে না। শক্ত করে গিঁট দেয়া যাবে না, এতে করে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তবে পাতলা গামছা বা শাড়ির ছেঁড়া অংশ দিয়ে লুস করে বেঁধে যেতে পারে।

কামড়ানো স্থান নড়াচড়া করলে বিষ দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। তবে রাসেল ভাইপার কামড়ালে কোন ভাবেই বাঁধা যাবে না। এতে রোগীর মারাত্নক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।


তৃতীয়ত রোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে ঝাড়ফুঁক করা, কিংবা কবিরাজি চিকিৎসা করে সময়ক্ষেপন করা যাবে না। সাপ কাটার জায়গা ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা যাবে না।


চতুর্থত রোগীকে যতো দ্রুত সম্ভব যে সকল হাসপাতালে এন্টিভেনম ঔষধ আছে সেই হাসাপাতালে নিতে হবে।


পঞ্চম রোগীকে সাপ কামড়ানোর সময় থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ সাধারনত সাপ কামড়ানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শরীরে বিষক্রিয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বিষক্রিয়ার কোনো লক্ষণ না হলে আর ভয়ের কোনো কারণ নেই।


সর্পদংশনের পর রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া হলে, বিষ নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ না দিলে মৃত্যু অবধারিত। আশার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের সরকার দেশের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালে বিষনিষ্ক্রিয় করার ঔষধ সরবরাহ করেছে এবং উপজেলা পর্যায়ে সর্প দংশনের চিকিৎসার জন্য প্রয়জনীয় উদ্যগগ্রহন করেছে।


রাসেল ভাইপার নিয়ে আমাদের আলাদা করে দুশ্চিতার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটি অন্য বিষাক্ত সাপগুলোর মতই এবং চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর সুস্থতা সম্ভব। তাই সাপে কামড় দিলে রোগী ও স্বজনদের প্রথম কাজ দ্রুত নিকটস্থ হাতপাতালে যাওয়া। এই একটি সচেতনতাই সাপে কামড়ানো অনেক রোগীকে বাঁচাতে পারে। তাই আমাদের সকলের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। সচেতন হয়। নিরাপদ থাকি।